মুহাদ্দিস হেদায়াতুল্লাহ সাহেব রহ: এর জীবন ও কর্ম

মুহাদ্দিস হেদায়াতুল্লাহ সাহেব রহ: এর জীবন ও কর্ম: 

যাকে নিষ্প্রয়োজনীয় কথা কেউ কোনদিন বলতে শোনেনি ৷ গুনাহের ছোঁয়া তো অনেক দূরে, যার কল্পনা হয়তো যিনি কোনোদিন করেননি, তীব্র রাগের মুহূর্তেও কোন উচ্চ আওয়াজ কোন কালে যার মুখ থেকে বের হইনি, সকাল-সন্ধ্যা এক নীরব সাধনা ও অধ্যবসায় নিয়ে কেটেছে যার পূর্ণ জীবন, মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যাকে দান করেছেন ইলমে হাদীসের শিক্ষা,  হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহ আলাইহি যাকে ধন্য করেছেন আধ্যাত্মিক দ্বীক্ষায়,  মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি যাকে ছাত্র বলে গর্ববোধ করতেন, যার জীবন ছিল সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ, নিষ্কন্টক, ইলমে দ্বীনের যিনি ছিলেন একনিষ্ঠ খাদেম,  তিনি হলেন এক মহান শিক্ষানুরাগী হযরতুল আল্লাম আল্লামা মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৷

যুগে যুগে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ দেশ জাতি ও ধর্মের বৃহত্তর খেদমত আঞ্জাম দিয়ে মুসলিম ইতিহাসের সম্মানজনক স্বর্ণোজ্জ্বল তালিকায় নিজ নাম অঙ্কিত করে নেওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন,  বিংশ শতাব্দীর হাদীস শাস্ত্রের অন্যতম প্রাণপুরুষ মরহুম আল্লামা হিদায়াতুল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদের অন্যতম ৷  পাঁচ যুগেরও অধিক কাল পর্যন্ত তিনি ইলমে দ্বীনের গুরুত্ব পূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দেন৷ ইলমে হাদীসের প্রচার-প্রসার ও মানব জীবনে তার যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক নীরব বিপ্লবী মহাপুরুষ ৷

জন্ম ও শিক্ষা:

তিনার প্রকৃত নাম "হিদায়াতুল্লাহ" ৷ পিতার নাম জনাব "মুবারকল্লাহ" ৷ হেদায়াতুল্লাহ সাহেব রহ: তার
মূল নামের চাইতে "মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর" নামেই অধিক প্রশিদ্ধ ছিলেন ৷  তিনি চাঁদপুর জেলাধীন শাহতলীর পার্শ্ববর্তী মুমিনপুরে  1908 সালে জন্মগ্রহণ করেন ৷

মুহাদ্দিস সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ এলাকাতেই শিক্ষা গ্রহণের সূচনা করে প্রাথমিক শিক্ষা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়ায়  লাভ করেন ৷  ফজিলত স্তর তথা মিশকাত শরীফ পর্যন্ত বাংলাদেশে পড়াশোনা করে বাকি শিক্ষা সমাপন ও বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন এবং দীর্ঘ 6 বছর সেখানে অবস্থান করে ইলমে জাহেরী ও ইলমে বাতেনীর  উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তা প্রসারের চিন্তা নিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন ৷  ইলমে দ্বীন তথা ইলমে জাহিরির শিক্ষা  সমাপান্তে দীর্ঘ এক বছর তিনি হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহমাতুল্লাহ থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করেন ৷

 নিজ দেশে ফিরে এসেই মুহাদ্দিস রহ:  দ্বীনি এলেম প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন ৷  প্রথমত তিনি ঢাকাস্থ বড় কাটারা মাদরাসায় অধ্যাপনা শুরু করে এখানে দীর্ঘ 12/14 বৎসর  তিনি নির্ভেজাল দ্বীনি শিক্ষার পিপাসায় বিভোর শিক্ষার্থীদের পিপাসা নিবারণ করেন অতঃপর তিনি 1953 সালে লালবাগ মাদ্রাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন ৷ এখানে তিনি 34 বছর যাবৎ কাল অধ্যাপনা করেন ৷ এ সময় তিনি তদানীন্তন কালের সবচাইতে বৃহত্তর সেই ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ এর প্রিন্সিপাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ৷ অতঃপর তিনি জীবনের সর্বশেষ দিনগুলো ঢাকার যাত্রাবাড়ীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া কাটান ৷

মুহাদ্দিস সাহেবের অধ্যাপনা তথা হাদিসের দরস এক ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল ৷ হাদীস শাস্ত্রের মধ্যে অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ হাদিস গ্রন্থ বুখারী শরীফ ও তিরমিযি শরীফ পড়ানোর ক্ষেত্রে হযরত রহমাতুল্লাহ আলাইহির অসাধারণ পান্ডিত্ব ও কৃতিত্বের অগণিত জীবন্ত সাক্ষী আজও বাংলা আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে ৷ এক্ষেত্রে হযরতের দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই ৷ এক অসাধারণ ভাবগম্ভীর পরিবেশে তিনি দরসে হাদিস পরিচালনা করতেন ৷ হাদিসের দরসে সামান্যতম কোন কাজ  তিনি বরদাস্ত করতেন না ৷ কারণ এ জাতীয় বিষয়াবলী হাদিসের দরসের আদব বা শিষ্টাচার পরিপন্থী ৷ তিনি এমনটি লক্ষ করলে তাৎক্ষনিক ভাবে দরস মওকুফ করে দিতেন ৷ এজন্য হযরতের ছাত্রদেরকেও দরসে  বসতে হতো যথেষ্ট সচেতন ও বিনয়ী হয়ে ৷
এছাড়া অন্যান্য বিষয়ের দর্স দানের ক্ষেত্রেও মুহাদ্দিস রহ:  ছিলেন এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত ৷ লালবাগের জীবনে একবার হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহমাতুল্লাহ ইলমে নাহু এর সর্বোচ্চ কিতাব শরহে জামী  পড়াচ্ছিলেন; তিনার  পড়ানোর ধরন প্রত্যক্ষ করার জন্য লালবাগ জামেয়ার তৎকালীন প্রিন্সিপাল  মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি ও উক্ত জামিয়ার স্বনামধন্য মুফতি আবদুল মুঈয সাহেব রহমতুল্লাহি আরো দুই একজনকে নিয়ে চুপে চুপে দরসগাহের পাশে দাঁড়িয়ে  হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি এর পড়ানোর অবস্থা দেখে এসে যে মন্তব্য করেছিলেন  সে মন্তব্যই হযরতের ক্ষেত্রে অগাধ পাণ্ডিত্যের প্রমাণ বহন করে ৷ তারা মন্তব্য করেছিলেন, আজ যদি শরহেজামীর লেখক মোল্লা জামী  রহমাতুল্লাহ আলাইহি জীবিত থাকতেন তবে মনে হয় তিনি এভাবেই শরহে জামী পড়াতেন, যেভাবে মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ পড়াচ্ছেন ৷

এছাড়া হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি হিদায়াতুল্লাহ সাহেব রহমতুল্লাহিকে  লালবাগ জামেয়ার কুতুবখানা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন;  লালবাগ জামেয়ায় দুটি কুতুবখানা রয়েছে,  একটি যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ আর অপরটি হলো,  জিন্দা কুতুবখানা৷ আর  হচ্ছে আমাদের মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ ৷
হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মন্তব্য হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহির জীবনে ছিল সদা বিদ্যমান ৷ কারণ যেকোন বিষয়ে যে কেউ যখনই কোনো সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হত, মুহাদ্দিস সাহেব তাৎক্ষনিকভাবে তার ইসলাম ও শরীয়ত সম্মত সঠিক রায় জানিয়ে দিতেন ৷ অনেক ক্ষেত্রে তিনি কিতাবের উদ্ধৃতি পৃষ্ঠাসহ মুখস্থ বলে দিতেন৷
এছাড়া যেকোন বিষয়ে যে কোন কিতাবের জটিল বা দুর্বোধ্য  স্থানগুলোকে সহজবোধ্য করে বুঝিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তিনি আপন জীবনে বহুবার রেখেছেন ৷

মুহাদ্দিস সাহেবের উস্তাদ মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি (সদর সাহেব) হযরত মুহাদ্দিস সাহেবকে দুটি বিশেষ বিশেষণে ভূষিত করেন ৷ একটি হলো "আমিনু হাযিহিল উম্মাহ" (অর্থাৎ এ উম্মতেরসব চাইতে অধিক আমানতদার ব্যক্তি)  আর অপরটি হলো,  "সাহিবে রায়" (অর্থাৎ সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমর্থবান  ব্যক্তি) এ দুটি বিশেষনএকটু গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করা হলেই আমরা হযরত রহমাতুল্লাহ আলাইহির বিশ্বস্ততা, খোদাভীরুতা, গভীরতা ও বিচক্ষণতা সম্যক অনুধাবন  করতে পারি ৷

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর বিশ্বস্থতা ও আমানতদারী লক্ষ্য করে তদানীন্তন সময় তাকে "আমিনু হাযিহিল  উম্মাহ" অর্থাৎ এউম্মতের সর্বাধিক আমানতদার ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন৷ তদ্রুপ হযরত সদর সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি তার যোগ্য শাগরিদ মুহাদ্দিস রহ: কে  "আমিনুল উম্মাহ" উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন ৷

আর হয়ত এ কারণেই হযরত সদর সাহেব হুজুর রহমতুল্লাহি আলাইহি হেদায়েতুল্লাহ সাহেবকে তৎকালীন সময়ের সবচাইতে খ্যাতনামা ও ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছিলেন, "হেদায়েতুল্লাহ জামেয়ার জন্য একটি পাহাড় স্বরূপ ৷  এ পাহাড় যতদিন এ দায়িত্বে থাকবে ততদিন গান থাকবে আমিও তার খ্যাতি ও ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকবে" ৷

হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি এর অনাড়ম্বর জীবন ছিল সম্পূর্ণ লৌকিকতা মুক্ত ৷ তিনি ছিলেন সাদাসিধা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে একটি প্রকৃষ্ট নজীর ৷ পান ছিল হযরত রহমতুল্লাহি আলাইহি এর একটি পছন্দনীয় ও নিয়মিত খাদ্য৷ পান -সুপারীসহ নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তিনি নিজেই বাজার থেকে খরিদ করে আনতেন ৷ কখনো গভীর রাতে তিনি নিজেই নিজের জামা কাপড় ধৌত করতেন ৷  অথচ তিনি ছিলেন তখন লালবাগের মতো ঐতিহ্যবাহী জামিয়ার প্রিন্সিপাল৷ যখন হাজার হাজার ছাত্রের প্রত্যেকেই হযরতের একটু খেদমত করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতো ৷

মোটকথা মাওলানা হেদায়েত উল্লাহ সাহেবের ব্যাপক, বৃহত্তর খেদমত ও তার সুউচ্চ এবং উন্নত গুণাবলীর যথার্থ বর্ণনা দিয়ে শেষ করা সম্ভব নয় ৷  হযরতকে এক কথায় বোঝার জন্য আমরা বলতে পারি যে, তার কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায় সম্বলিত জীবনযাত্রা সাহাবী ও তাবেয়াগণের জীবনযাপন প্রণালীর সাথে একান্তভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল ৷  নিরিবিলি পরিবেশে নিজেকে একনিষ্ঠ সাধনায় লিপ্ত রাখাই ছিল তিনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ৷ পূর্বেকার যুগের যেসকল অলি,বুযুর্গ ও মনীষীর জীবনকথা আমরা বই পুস্তুকে দেখতে পাই,  মুহাদ্দিস সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন  সে পর্যায়ের একজন মহান ব্যক্তিত্ব ৷  অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা তিনার মুখ থেকে বের হওয়া যেন ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব ৷

মৃত:  দ্বীনের এই মহান সিপাহসালার বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য ভক্ত বৃন্দ ও গুণগ্রাহীদের কাঁদিয়ে বিগত 22 শে মার্চ 1996 ইং শুক্রবার বাদ ফজর তিনি এ নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য প্রকৃতনিবাস পরপারের পথে চলে গেছেন ৷
মহান রবের কাছে আমাদের হৃদয়ের একান্ত আকুতি রাব্বে কারীম যেন তাঁকে  আপন বিশেষ অনুগ্রহে চির সাফল্য ও সৌভাগ্য মন্ডিত করেন এবং মরহুমকে দান করেন জান্নাতুল ফিরদাউসের উন্নত ও উচ্চতম মাকাম ৷ আমিন৷

0 Comments